কৃষিবিপ্লবে নেতৃত্বে বাংলাদেশ

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে কৃষি খাতে অভাবনীয় বিপ্লব সাধিত হয়েছে। কৃষির বিভিন্ন উপখাতের ক্রম অগ্রগতি বিশ্বের বিভিন্ন সূচকেও প্রভাব বিস্তার করেছে। পাল্টে দিয়েছে কৃষি উৎপাদনের পুরনো হিসাব-নিকাশ। ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে সীমিত ভূখণ্ডে অসীম সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পরিশ্রমী কৃষক, তাদের উদ্ভাবনী উদ্যোগ এবং সরকারের বিভিন্ন তৎপরতায় উৎপাদন বিপ্লবে বাংলাদেশের এ অসামান্য অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন কৃষি বিশ্লেষকরা।

বিশেষজ্ঞরা জানান, স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪৪ বছরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এই সময়ে আবাদি জমির পরিমাণও অনেক কমে গেছে। উপরন্তু বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রাকৃতিক পরিবেশে ফসলহানির ঘটনাও ঘটেছে। তবুও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে উজ্জ্বল উদাহরণ। ধান, গম ও ভুট্টার ক্ষেত্রে বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। শাকসবজি ও ফলমূলের সঙ্গে সাম্প্রতিক আলু রপ্তানি এ দেশের কৃষির উল্লেখযোগ্য সাফল্য।

খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য পথিকৃৎ। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ইতিমধ্যে ৬৭টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) উদ্ভাবন করেছে ১৪টি ধানের জাত। এর বাইরে বেসরকারি বীজ কোম্পানিগুলো ১১৫টি হাইব্রিড ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। এ ছাড়া ব্রি ও বিনার বিজ্ঞানীরা ১৩টি প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে লবণসহিষ্ণু নয়টি, খরাসহিষ্ণু দুটি ও বন্যাসহিষ্ণু চারটি ধানের জাত। সব মিলিয়ে ধান গবেষণা ও উৎপাদনে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় অগ্রগতি লাভ করেছে। স্বাধীনতার পর দেশে প্রতি হেক্টর জমিতে ধান উৎপাদন হতো ২ টন। এখন উৎপাদন হচ্ছে ৪ টনেরও বেশি। স্বাধীনতার পর দেশে ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি বেড়েছে। গত পাঁচ বছরে দেশের মানুষকে খাওয়াতে বাংলাদেশ কোনো চাল আমদানি করেনি। বরং শ্রীলঙ্কায় চাল রপ্তানি শুরু করেছে। গত বছর বিশ্বে প্রথমবারের মতো জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন দেশের কৃষি গবেষকরা। হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ আর মোট ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। এ ছাড়া বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরআই) এ পর্যন্ত ২৬টি জাত অবমুক্ত করেছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) বেশ কয়েকটি জাত উদ্ভাবন ছাড়াও পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছে। গত পাঁচ বছরে তারা ছয়টি জাত অবমুক্ত করেছে। আরও দুটি জাত অবমুক্তির অপেক্ষায় আছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৪ সালে মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। মাছ উৎপাদনে চীন বিশ্বসেরা, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে যথাক্রমে ভারত ও মিয়ানমার। তারপরই বাংলাদেশ। এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে তার মধ্যে প্রথম দেশটি হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে বলা হয়, ২০১৩-১৪ সালে বাংলাদেশে ৩৪ লাখ ৫৫ হাজার টন মাছ উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে চাষের মাছের পরিমাণ ছিল প্রায় ২০ লাখ টন। জাটকা সংরক্ষণসহ নানা উদ্যোগের ফলে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাছ ইলিশের উৎপাদন ৫২ হাজার টন বেড়ে সাড়ে ৩ লাখ টন হয়েছে। মাছ রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে ১৩৫ গুণ।

বিশ্বে মোট আম উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায়। আর বাংলাদেশের অবস্থান নবম। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সর্বশেষ মূল্যায়নে বলা হয়েছে, প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টন আম উৎপাদনের মাধ্যমে এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। বিবিএসের তথ্যমতে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৮ লাখ ৪২ হাজার আর ২০১০-১১-এ ৮ লাখ ৮৯ হাজার টন। ২০১১-১২ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে যায় প্রায় সাড়ে ৯ লাখ টনে। যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের ল্যাংড়া ও আম্রপালি আম। বাংলাদেশে ৬০ ধরনের ও ২০০ জাতের সবজি উৎপাদন হচ্ছে। এসব সবজির ৯০ শতাংশ বীজই দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। গত এক যুগে দেশে মাথাপিছু সবজির ভোগ বেড়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ। পাশাপাশি গত এক বছরে শুধু সবজি রপ্তানিতে আয় বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি হারে সবজির আবাদি জমির পরিমাণ বেড়েছে বাংলাদেশে, এ বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ। ১৯৯৪ সালে দেশে মাথাপিছু দৈনিক সবজি খাওয়া বা ভোগের পরিমাণ ছিল ৪২ গ্রাম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) হিসাবে ২০১৪ সালে দেশে মাথাপিছু সবজি ভোগের পরিমাণ ৭০ গ্রাম।

উল্লেখ্য, রাজধানীর প্রায় দেড় কোটি মানুষের সবজি চাহিদার একটি বড় অংশের জোগান আসছে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো থেকে। বাজার চাহিদার কারণে রাজধানীর চারপাশে সবজি উৎপাদনের বিশাল ক্ষেত্র গড়ে উঠেছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময়। তখন রাজধানীর সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলেও বাজারে সবজির অভাব হয়নি। ২০১৩ সালের শেষ দিকে বিএনপি-জামায়াতের সহিংস আন্দোলনের সময় দীর্ঘদিন রাজধানী সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। এ সময়ও ঢাকাবাসীর সবজি চাহিদার অনেকটাই পূরণ করেছেন পার্শ্ববর্তী এলাকার চাষিরা। কৃষি খাতে বিভিন্ন সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মাননা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়। গত ২০ মে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক রোনি কোফিম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের তার প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্টের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে একটি সম্মাননাপত্র হস্তান্তর করেন। এতে বাংলাদেশের কৃষি খাতের উন্নয়নে, খাদ্য উৎপাদনে স্বাবলম্বিতা অর্জনে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নয়নে শেখ হাসিনার অবদানকে সমর্থন জানানো হয়। জানা গেছে, কৃষকদের স্বল্পসুদে ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি রাসায়নিক সার, জ্বালানি, হাইব্রিড বীজ এবং আমদানিযোগ্য কীটনাশক সরকার উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে আমদানি করে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর বাম্পার ফলনের মাধ্যমে মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আগের মেয়াদের দ্বিগুণ হয়ে এখন প্রায় ৪ কোটি টনের কাছাকাছি। দানাদার খাদ্য উৎপাদনে মূল কৃষির পাশাপাশি এর উপখাত হিসেবে প্রোটিনের উৎস মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদিতেও স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে এখন বিদেশে রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। শ্রমঘন শিল্প হিসেবে কৃষির অগ্রগতিতে গত কয়েক দশকে ভূমিকা রেখেছে নিত্যনতুন প্রযুক্তি। কৃষিজমি তৈরিতে যন্ত্রনির্ভরতা বাড়ায় আগের তুলনায় সাশ্রয়ী হয়েছে উৎপাদন। এর পাশাপাশি বীজ বুনন, ধান কাটা, নিড়ানি, মাড়াইসহ বিভিন্ন কাজে প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে এ দেশের কৃষক। এতে আগের চেয়ে অনেক আধুনিক হয়েছে কৃষিপণ্যের উৎপাদন। কৃষি খাতে বাংলাদেশের এই অভাবনীয় সাফল্যের নেপথ্যে সরকারের নীতি ও পরিকল্পিত পদক্ষেপকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, সরকারের বাস্তবমুখী কৃষিনীতি এবং সে অনুযায়ী বাজেটসহ অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণ দেশকে কৃষি উন্নয়নের এক রোল মডেল হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। কৃষিতে ভর্তুকি, সফল সার, বীজ ও সেচ ব্যবস্থাপনা, গবেষণায় প্রণোদনা, গ্রামীণ অবকাঠামো ও রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে কৃষিপণ্যের নিরবচ্ছিন্ন পরিবহন, উন্নত বীজের জন্য মৃতপ্রায় বিএডিসিকে শক্তিশালীকরণ প্রভৃতি কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করছে। আধুনিক কৃষিবিপ্লবের অগ্রপথিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ কৃষিবিপ্লবে বাংলাদেশের সাফল্যের নেপথ্যে বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করে বলেন, দীর্ঘদিনের গবেষণার ফল এবং কৃষক পর্যায়ে তার সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কৃষি খাতে অভাবনীয় অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। তিনি বলেন, কৃষির উপখাত- ডেইরি, ফিশারি, পোল্ট্রির ক্ষেত্রে বিশাল বিপ্লব হয়ে গেছে। সরকারের দীর্ঘ মেয়াদে সমর্থন, ভর্তুকি মূল্যে বীজ, সার, কীটনাশকের জোগান দেওয়ার ফল এটা। উপখাতগুলোর আরও অনেক সম্ভাবনা রয়েছে, যা কাজে লাগাতে হবে। দেশের কৃষি খাত যুগান্তকারী কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কৃষি খাতে এখন তথ্যপ্রযুক্তি যুক্ত হচ্ছে; যার ফলে দ্রুত এ খাত এগিয়ে যাচ্ছে। শাইখ সিরাজ আরও বলেন, আমরা এখনো কৃষিপণের সঠিক মূল্য দিতে পারছি না। কৃষিপণ্যের সঠিক মূল্য দেওয়া গেলে কৃষকদের জীবনমান, সামাজিক মর্যাদা অনেক বেড়ে যেত। ১১ কোটি মানুষ এখন গ্রামে থাকে। কৃষকের জীবনমান উন্নত হলে দেশটা দ্রুত পাল্টে যাবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর